অফিস ডেস্ক
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরবর্তী সভাপতি হিসেবে অনেক দিন থেকেই আলোচনায় তামিম ইকবালের নাম। তাঁর সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা থাকলেও সাবেক এই অধিনায়ক বরাবর নীরব থেকেছেন। নানা গুঞ্জন ডালপালা মেললেও এর আগে কখনোই বিসিবির নির্বাচন নিয়ে কথা বলেননি তিনি। তবে এবার ব্যতিক্রম।
এই প্রথম বিসিবির আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তামিম।
অনেক দিন থেকে শোনা যাচ্ছে, আপনি বিসিবি সভাপতি হওয়ার লড়াইয়ে নামছেন। এত দিনে নিশ্চয়ই খবরটি বাস্তবতার ভিত খুঁজে নিয়েছে?
তামিম ইকবাল খান : দেখুন, কেউ তো আগে থেকেই বলতে পারে না যে সভাপতি হব। আমিও অনেক কিছু দেখি, অনেক কিছু শুনি।
তবে মূল প্রশ্নটি হওয়া উচিত, আমি (বিসিবির) নির্বাচন করব কি করব না। অন্য ফোরামের কথা যদি বলি, ধরুন কোয়াবের (ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) কথাই। ওখানে সভাপতি পদে সরাসরি নির্বাচন করার সুযোগ আছে। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডে তো ব্যাপারটি এমন নয়।
এখানে আগে নির্বাচন করে পরিচালক হয়ে আসতে হবে। এরপর সভাপতি পদে দুজন দাঁড়ালে পরিচালকদের ভোটে একজন নির্বাচিত হবেন। তাই প্রশ্ন যদি করেন, আমি বিসিবির নির্বাচনে অংশ নেব কি না, এটি বলতে পারি যে আমার খুব ভালো সম্ভাবনা আছে। এবার নির্বাচন করছি আমি।
প্রশ্ন : কিন্তু তামিম নিশ্চয়ই শুধু পরিচালক হওয়ার জন্য নির্বাচন করবেন না?
তামিম : দেখুন, এটি সময়ই বলবে।
আমি যদি এখনই বলি যে সভাপতি হতে চাই, সেটি বলা কতটা যৌক্তিক হবে আমি জানি না। (পরিচালক হওয়ার পর) যদি মনে হয় যথেষ্ট সমর্থন আমার আছে, তখন চিন্তা করে দেখা যেতে পারে। এই মুহূর্তে শুধু এটুকুই বলার আছে যে আমার নির্বাচন করার জোরালো সম্ভাবনা।
প্রশ্ন : আপনি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা বললেন। আগে পরিচালক হলে তবেই সভাপতি পদে দাঁড়ানোর প্রশ্ন। এর আগে তো আপনাকে কাউন্সিলরও হতে হবে। সেই প্রক্রিয়া কি চূড়ান্ত হয়েছে?
তামিম : হ্যাঁ, আমি ক্রিকেটে বিনিয়োগ করেছি। দুটি ক্লাবের সঙ্গে আছি। কাউন্সিলর তো আমি হবই।
প্রশ্ন : অবশ্য ছয় মাস আগেও নির্বাচনের বিষয়ে আপনার অবস্থান এমন ছিল না। তখন বরং বলেছিলেন, কিছু খারাপ লোক থাকলে আপনি এর মধ্যে নেই। এখন কি পরিবেশ আপনার নির্বাচন করার উপযোগী হয়েছে?
তামিম : দেখুন, ক্রিকেটের যাঁরা স্টেকহোল্ডার (অংশীদার), তাঁরা সবাই একটি জিনিস মুখে বলেন। সেটি হচ্ছে ক্রিকেটে যেন কোনো রাজনীতি না থাকে। কিন্তু আসলে হচ্ছেটা কী? এই যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের লেগে যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে নিয়ে মানুষের মধ্যে বাজে ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এই আলোচনাটা একদমই হচ্ছে না যে ক্রিকেটের জন্য কোন প্রার্থী ভালো? হ্যাঁ, ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হতে আগ্রহী অনেকে। মূল ফোকাসটা থাকা উচিত এঁদের মধ্যে কে ওই পদে কতটা ভালো। অন্য আলোচনা অবশ্যই থাকবে। তবে মূল আলোচনাটা প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে হলে সবার জন্য ভালো। কারণ দিনের শেষে সবাই চায়, যে-ই আসুক, ক্রিকেট যেন জেতে। একজনের পেছনে আরেকজনের লেগে থাকা বাদ দিয়ে এই ট্রেন্ডটা আমাদের শুরু করা উচিত। এখন যেগুলো হচ্ছে, তা মোটেও ভালো নয়। অমুক তমুককে পচাচ্ছে, তমুক অমুককে নিয়ে মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছে। দেখছেন তো সবই। অনেক কিছুর মধ্যে সত্যতাও আছে, আবার নেইও। এসব বাদ দিয়ে কে নতুন আইডিয়া নিয়ে আসবেন, কাকে ক্রিকেটের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার, আলোচনা সেদিকে ঘোরা দরকার। মিডিয়া থেকে শুরু করে সবার কথায় একটা জিনিস থাকে যে বাংলাদেশকে আধুনিককালের ক্রিকেট খেলতে হবে। সে রকম ক্রিকেট খেলতে হলে পরিচালক যাঁরা হবেন, তাঁদের চিন্তা-ভাবনাও তো আধুনিক হতে হবে। এ রকম তো নয় যে ক্রিকেটাররাই শুধু আধুনিক খেলা খেলবে। যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁদের চিন্তাধারা ৩০ বছর আগের হলে সমস্যা। তাঁদেরও আধুনিক হতে হবে। এই আধুনিক ব্যাপারটা কে ক্রিকেটে নিয়ে আসতে পারবেন, আলোচনাটা হওয়া উচিত এ রকম।
প্রশ্ন : নতুন আইডিয়া ও আধুনিক চিন্তা-ভাবনার কথা বললেন, বিসিবিতে এলে আপনি কী করার কথা ভেবেছেন?
তামিম : নির্বাচনে জিতলে চার বছরের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেবা করবেন আপনি। এই সময়ের মধ্যে খুব বেশি কিছু ভাবতে গেলে তেমন কিছুই করতে পারবেন না। সবকিছুই বকেয়া রয়ে যাবে। অনেক মানুষকে আমি নির্বাচনের আগে বলতে শুনি, এটা করে ফেলব, ওটা করে ফেলব। শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। আমি মনে করি, আমার ফোকাস থাকা উচিত সর্বোচ্চ দুটি বা তিনটি বিষয়ের ওপর। এর চেয়ে বেশি দিকে দৃষ্টি থাকলে মনে হয় না বাস্তবায়ন করতে পারব। দ্বিতীয়ত, ওগুলো শুধু বলার জন্য বলা হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কী দরকার? কাছাকাছি সময়ের মধ্যে যেহেতু আমি ক্রিকেট ছেড়েছি এবং ২০-২৫ বছর ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত, আমার কাছে মনে হয়, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। আপনার কাছে খেলোয়াড়, কোচ—সবই আছে, কিন্তু নতুন খেলোয়াড় বের করার অবকাঠামো নেই। যে খেলোয়াড়রা আছে, তাদের উন্নতির জন্য কোনো জায়গাও নেই। ঘুরেফিরে ওই একাডেমি মাঠেই অনুশীলন করার জন্য আসতে হয়। এখনো বিপিএল বা ডিপিএলের সময় একটি মাঠে সাতটি দল অনুশীলন করে। বিসিবিকে বিশ্বের সেরা পাঁচটি ধনী ক্রিকেট বোর্ডের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয় যে ১৩০০ কোটি টাকার এফডিআর আছে। অথচ ইংলিশ কাউন্টির একটি দলের মতো সুযোগ-সুবিধাও আপনার নেই।
প্রশ্ন : বিসিবির নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের এই আলোচনাও শুরু করা উচিত বলে মনে করছেন?
তামিম : হ্যাঁ, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো নিয়ে কোনো আলোচনাই শুনছি না। আমি আসতে পারলে চার বছরের মধ্যে ওই সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিতে চাই, যাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট আগামী ৮-১০ বছরের জন্য ঠিক থাকে। উদাহরণ দিই একটা। ধরুন, আমি একটা ব্যবসা শুরু করলাম। দোকান খুললাম, মার্কেটিং করলাম, কিন্তু আমার কোনো ফ্যাক্টরিই নেই। তাহলে আমার প্রোডাক্ট তৈরি হবে কোন জায়গা থেকে (হাসি...)?
প্রশ্ন : ফ্যাক্টরি তৈরিতে মনোযোগ দিতে চান তাহলে?
তামিম : ঠিক তাই। সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সময় লাগে। কিন্তু সেটি বাড়ানোর চিন্তা করতে সময় লাগে না। একটি স্টেডিয়াম গড়তে সময় লাগে। তাই বলে স্টেডিয়াম বানানোর চিন্তা করতে ছয় মাস এক বছর লাগার তো কথা না। আমি দেখি যে-ই আসে, সে-ই বলে একটি স্টেডিয়াম করা দরকার। তবে আমি স্টেডিয়াম বানানোর বিষয়টি আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে মনে করি না।
প্রশ্ন : কোন জায়গাটি বেশি গুরুত্ব দাবি করে?
তামিম : যে স্টেডিয়ামগুলো আছে, এর বেশি আর দরকার নেই। হ্যাঁ, সংস্কার করতে পারেন। সবচেয়ে জরুরি সুবিধা বাড়ানো। আপনার এক্সিলেন্স সেন্টার না থাকলে ১০টি স্টেডিয়াম থেকেই বা কী লাভ? খেলোয়াড় তৈরির জায়গা না থাকলে স্টেডিয়াম দিয়ে কী করবেন? ভারতের উদাহরণ দিই। ওরা বেঙ্গালুরুতে একটি এক্সিলেন্স সেন্টার করেছে। একই রকম কিছু বাংলাদেশেও করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে এটি জরুরি। এটি করে দেওয়া মানে খেলোয়াড়দের তৈরি হওয়ার একটা জায়গা করে দেওয়া। আজীবন একটা কথা শুনে আসছি—উইকেট খারাপ, উইকেট খারাপ! কিন্তু এটি বদলানোর জন্য কে কী করছে? কথা তো সবাই বলে। এর পাশাপাশি আরেকটি জায়গায় কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন : কোন জায়গায়?
তামিম : উদাহরণ হিসেবে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার কথাই বলি। ওসব দেশে বেশির ভাগ ক্রিকেটার বেরিয়ে আসে স্কুল থেকে। এই জায়গাটায় আমরা অনেক পেছনে। আমাদের এখানে স্কুল ক্রিকেট কাঠামো খুবই দুর্বল। আমরা নামকাওয়াস্তে একটি টুর্নামেন্ট করি। আমি মনে করি, বিসিবির অনেক বেশি বিনিয়োগ করা উচিত স্কুল ক্রিকেটে। সেখানে বিনিয়োগ করলে এক পর্যায়ে স্কুলও আগ্রহী হবে। আগে উদ্যোগটা নিতে হবে বিসিবিকে। শ্রীলঙ্কায় দেখেছেন, এক স্কুলের সঙ্গে আরেক স্কুলের লড়াইয়ের সময় ‘কার্নিভাল’ হয়ে যায়। উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। স্কুল ক্রিকেটটা ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের মতো সিরিয়াসলি করতে হবে। নতুন প্রতিযোগিতার জায়গা তৈরি করলে নতুন খেলোয়াড়ও বের হতে থাকবে। আমি ব্যাগ ভর্তি আশা নিয়ে বিসিবিতে যেতে চাই না। বেশি জায়গায় দৃষ্টি দিলে শেষে কিছুই করা হবে না। যে কয়েকটি জায়গার কথা বললাম, সেসব নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চাই। আরো কিছু জায়গা নিয়ে কাজ করতে চাই। তবে সব এখনই বলে দিতে চাই না।
প্রশ্ন : যত স্বপ্নের কথা বললেন, বিসিবির একটি নির্দিষ্ট চেয়ারে না বসলে সেগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব। আপনি নিজেও জানেন যে বিসিবি মানেই ‘ওয়ান ম্যান শো’। অর্থাৎ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তার মানে ধরে নিতে পারি, পরিচালক নির্বাচিত হলে আপনি সভাপতিও হতে চাইবেন?
তামিম : সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলে রেখেছি, এখনই সভাপতি হতে চাওয়ার কথা বলাটা বোকামি হবে। শুধু সভাপতি পদে নির্বাচন হলে বলতে পারতাম যে ওখানে আমি দাঁড়াচ্ছি কি দাঁড়াচ্ছি না। বিষয়টি নির্ধারিত হবে পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর। সেটি হওয়ার পর যদি মনে হয় অনেকে আমার পক্ষে আছে, তাহলে হতেই পারি। এই মুহূর্তে বলব, আগে পরিচালক হই। বাকিটা পরে দেখা যাবে। হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে আমি একমত। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে গেলে আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারটিতে বসা জরুরি। আমিও মনে করি, ক্রিকেট বোর্ডে এলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ক্ষমতাও আমার থাকা উচিত।