অফিস ডেস্ক
প্রতিবেদন প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, সময়ঃ ০৪:২০
সাত দিন আগে তীব্র জ্বর, গায়ে ব্যথা ছিল নারায়ণগঞ্জের আমেনা বেগমের (৪৮)। ওষুধে জ্বর কমছিল না। পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। রক্তের প্লাটিলেট কমে ৪০ হাজারে নেমে এলে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ১ জুলাই
থেকে তিনি মহাখালীতে অবস্থিত উত্তর সিটি করপোরেশন পরিচালিত ডিএনসিসি কোভিড–১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে হাসপাতালের পঞ্চম তলায় অবস্থিত আইসিইউর সামনে গিয়ে দেখা হয় আমেনা বেগমের ছেলে অর্ণব মোহাম্মদের সঙ্গে। অর্ণব জানান, ভর্তির পরদিন তাঁর মায়ের প্লাটিলেট আরও কমে ১৮ হাজারে নেমে আসে। মাকে দেখভালের জন্য চার দিন ধরে তিনি ও তাঁর বাবা মো. সালাউদ্দিন হাসপাতালে রয়েছেন। রাতে বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমান।
আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে জান্নাতুল (১৭) নামের একটি মেয়ে। পরিবারের সদস্যরা তার জন্য রক্ত জোগাড় করছিলেন। জান্নাতুলের মা আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শেখেরটেকে থাকেন। ১০ জুন মেয়েকে নিয়ে তিনি পটুয়াখালী সদর উপজেলায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ২৭ জুন সেখানে মেয়ের প্রচণ্ড জ্বর হলে তিনি পরদিন জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষায় জান্নাতুলের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন অনেক বেশি। চিকিৎসকের পরামর্শে ৩০ জুন তিনি ঢাকায় এসে ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করেন। মেয়েকে রক্ত দেওয়া হয়েছে এক ব্যাগ। শুক্রবারের রিপোর্টে প্লাটিলেট কমে ৬ হাজারে নেমে আসায় চিকিৎসক আরও রক্ত দিতে হবে জানিয়েছেন।
অর্ণব জানান, ভর্তির পরদিন তাঁর মায়ের প্লাটিলেট আরও কমে ১৮ হাজারে নেমে আসে। মাকে দেখভালের জন্য চার দিন ধরে তিনি ও তাঁর বাবা মো. সালাউদ্দিন হাসপাতালে রয়েছেন। রাতে বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমান।
হাসপাতালটির আইসিইউতে গতকাল ১৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে আমেনা বেগম, জান্নাতুলসহ ডেঙ্গু রোগী ৬ জন। হাসপাতালে গতকাল দুপুরে ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা করপোরাল মো. মিয়ারুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে এখন আইসিইউ ও ওয়ার্ড মিলিয়ে ১৩১ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী ২৬ জন, কোভিড রোগী ১৯ জন এবং অন্যান্য রোগী ৮৬ জন। এই হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের আলাদা ব্যবস্থা নেই। উপসর্গ থেকে তাঁরা ধারণা করছেন, কিছু রোগী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। তাঁদের অন্যান্য রোগীর সঙ্গে রাখা হয়েছে।
রাজধানীসহ সারা দেশে এখন জ্বর, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি। আগামী দুই মাসে এই রোগ আরও বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে ৩ থেকে ৪ জুলাই (২৪ ঘণ্টায়) ২০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। কেউ মারা যাননি। ঢাকা মহানগরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ওই সময়ে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৭ জন। এর মধ্যে ১৮টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ৪৫ জন এবং ৫৯টি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ জন। সবচেয়ে বেশি ভর্তি রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে—মোট ২৬ জন।
রাজধানীসহ সারা দেশে এখন জ্বর, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি। আগামী দুই মাসে এই রোগ আরও বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ জুন ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ১৫১ জন। আর ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোয় ওই সময় ভর্তি হয়েছিলেন ২৮ জন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. টিটো মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী অনেক বেশি আসছে। পাশাপাশি কোভিড রোগীও আসছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখনই সরকারি পদক্ষেপ না বাড়ালে ও জনসচেতনতা সৃষ্টি না করলে বিপদ বাড়তে পারে।
টিটো মিঞা আরও বলেন, বাথরুমের কোনায়, টবে, টায়ারে পানি জমে যেন ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তার না ঘটে, সে জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জ্বর হলে অবশ্যই রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা করতে হবে। প্লাটিলেটের চেয়ে রক্তচাপ কমে যাওয়ার বিষয়টি বেশি আশঙ্কাজনক। রোগীর রক্তচাপ কমে গেলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ জানান, রোগীর সংখ্যা আরও বাড়লে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
যত আক্রান্ত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ঢাকা মহানগরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন মোট ভর্তি আছেন ৩৫১ জন। ৩ থেকে ৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ৫৭ জন। সারা দেশে এই ২৪ ঘণ্টায় নতুন ২০৪ রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে ১০১ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৬৬০ জন। আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে, মোট ৫ হাজার ১৭০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪৫ জন। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকায়। সেসব এলাকায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ জানান, রোগীর সংখ্যা আরও বাড়লে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
অনেকে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন
রামপুরার বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খালেদা আকন্দ (৫৬) গত সপ্তাহে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। পরিবারে চিকিৎসক আত্মীয়স্বজন থাকায় মুঠোফোনে পরামর্শ নিয়ে ফলের রস, স্যালাইনসহ তরল খাবার খাচ্ছিলেন তিনি। তৃতীয় দিন পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। চতুর্থ দিন তাঁর চোখ লালবর্ণ ধারণ করে এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়া শুরু করে। ওই সময় চিকিৎসক স্বজনের পরামর্শে আরেকবার পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
খালেদা আকন্দের পুত্রবধূ স্কুলশিক্ষক শারমিন বাশার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শাশুড়ির গায়ের ব্যথা এখন কমে এসেছে। শারীরিক অবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে চলছেন।
উপসর্গ ডেঙ্গু–চিকুনগুনিয়ার, রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’
রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসায় দেড় বছর ধরে এক শিশুর তত্ত্বাবধানকারী (কেয়ারগিভার) হিসেবে চাকরি করেন হাফিজা বেগম (২২)। গত ২৯ জুন রাতে তাঁর ১০৫ ডিগ্রি জ্বর ওঠে। সঙ্গে গায়ের গিটে গিটে প্রচণ্ড ব্যথা, চুলকানি। তাঁর গায়ে এত ব্যথা ছিল যে হাঁটতে পারতেন না। হুইলচেয়ারে করে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হয়। শিশুটির মা ফাতেমা আবেদীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ জুন তিনি হাফিজাকে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসক দেখান। পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে হাফিজাকে তরল খাবার খাওয়ানো হচ্ছিল। তবে দুই দিন পর প্রচণ্ড বমি শুরু হয়। সঙ্গে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, চুলকানি। রাতের বেলা ধানমন্ডির আরেকটি হাসপাতালে হাফিজাকে ভর্তি করা হয়। এরপর রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা ও প্লাটিলেটের মাত্রা দেখে চিকিৎসক ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বলে ধারণা করেন এবং সেভাবে চিকিৎসা করেছেন। এক দিন হাসপাতালে থাকার পর হাফিজাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল।
মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে কোভিড আইসিইউ ইউনিটে চার বছরের শিশুসন্তানকে ভর্তি করেছেন এক মা। মিতু নামের ওই মা গতকাল হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মহাখালীতে থাকেন। তাঁর সন্তানের ডেঙ্গুর রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবে উপসর্গ দেখে চিকিৎসক ডেঙ্গু বলছেন। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে মেয়েকে।
রয়েছে কোভিড রোগীও
মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের ছয়তলায় কোভিড রোগীদের রাখা হয়েছে। হাসপাতালে মালা নামের এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর খালার স্বামী ও সন্তান মারা গেছেন। তিনি ছাড়া খালাকে দেখার কেউ নেই। খালা কিডনি রোগী। শ্বাসকষ্ট থাকায় তাঁকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে তাঁকে এই হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই হাসপাতালে তাঁর খালার কোভিড শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ৩–৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় ২৪২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের কোভিড শনাক্ত হয়েছে। কোনো মৃত্যু নেই।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি দরকার
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, আগস্ট–সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। মাঠপর্যায়ের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্দেশক ব্রেটো ইনডেক্স ২০-এর ওপরে, অর্থাৎ ডেঙ্গু বিস্তারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
কবিরুল বাশার আরও বলেন, গত ১১ মাসে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সেভাবে কার্যকর না থাকায় মশকনিধন কার্যক্রম তেমন ছিল না। ডেঙ্গুকে শহরভিত্তিক রোগ বলা হলেও এবার গ্রামে এর বিস্তার বেশি ঘটতে দেখা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ দরকার। দীর্ঘদিন ধরে মশা নিয়ে কাজ করছেন এমন বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা করা দরকার। পাশাপাশি আগামী দুই মাসে রোগীর চাপ সামলাতে হাসপাতালগুলোয় যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা দরকার। সাধারণভাবে হাসপাতালগুলোর রোগীর চাপ সামলানোর সক্ষমতা নেই।
© North Bangla News ২০২৫ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সতর্কতাঃ অনুমতি ব্যতীত কোন সংবাদ বা ছবি প্রকাশ বা ব্যবহার করা যাবে না।